ঢাকার নিম্ন আদালত থেকে বিপুল হারে খালাস পাচ্ছে ফৌজদারি মামলার আসামিরা। গত মে মাসে ফৌজদারি অপরাধের ৮৮ শতাংশ মামলার আসামিরা খালাস পেয়েছে আর মাত্র ১২ শতাংশ মামলায় আসামির সাজা হয়েছে। ফলে পার পেয়ে যাচ্ছেন ধর্ষণ, হত্যা, ডাকাতি, ছিনতাই, নারী ও শিশু নির্যাতনের মতো স্পর্শকাতর অপরাধের সঙ্গে জড়িতরাও। মূলত মামলার তদন্তে দুর্বলতা, সাক্ষীর অভাব, দীর্ঘ প্রক্রিয়া, নানাভাবে সময়ক্ষেপণ ও প্রসিকিউশনের দুর্বল ভূমিকার জন্য এমনটি হচ্ছে আইনজীবীরা বলে মনে করছেন। আর এ ধারা অব্যাহত থাকলে বিচারব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষ আস্থা হারাবে এবং আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবে অপরাধীরা। আদালত এবং ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চলতি বছরের মে মাসে বিচারপ্রক্রিয়া শেষে নিষ্পত্তিকৃত ১,৬৫৬টি মামলার মধ্যে খালাস পেয়েছেন ১,৩৯৩টির মামলার আসামিরা। সাজার রায় হয়েছে মাত্র ১৯৩টি মামলায় আর নিষ্পত্তি হয়েছে ৭০টি মামলা। এমনকি গত মে মাসে ধর্ষণ, হত্যা, নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন, এমনকি পুলিশ আক্রমণের মতো মামলায়ও সাজার হার আশঙ্কাজনকভাবে কম। ধর্ষণের ২৮টি নিষ্পত্তি হওয়া মামলার মধ্যে ২৭টিতে খালাস আসামিরা পেয়েছেন আর সাজা হয়েছে মাত্র ১টি মামলায়। নারী নির্যাতনের ৯৮টি নিষ্পত্তি হওয়া মামলার মধ্যে ৯৬টিতে আসামিরা খালাস পেয়েছেন। সাজা হয়েছে মাত্র ২টি মামলায়। মে মাসে মাদকদ্রব্য সংক্রান্ত ১০২৭টি মামলা নিষ্পত্তি হলেও তদদার মধ্যে ৮২৮ মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছে আর ১৪৭টিতে সাজা হয়েছে। তাছাড়া অন্যানভাবে ৫২টি মামলায় নিষ্পত্তি হয়েছে। সূত্র জানায়, আসামি অনেক কারণেই খালাস পেতে পারেন। ঘটনা সত্য হওয়ার পরও তদন্তে দুর্বলতার কারণেও অনেক সময় প্রসিকিউশনের পক্ষে অভিযোগ প্রমাণ করা সম্ভব হয় না। আবার ডাক্তারি পরীক্ষা, সুরতহাল প্রতিবেদন ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন সঠিক সময়ে এবং সঠিক পদ্ধতিতে না হওয়ায় খুন ও ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের মামলা প্রমাণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। আলামত নষ্ট হয়ে গেলে সদিচ্ছা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তার পক্ষে ঘটনার পূর্ণাঙ্গ রহস্য উদ্ঘাটন সম্ভব হয় না। তাছাড়া মামলা দায়েরের পর অনেক ক্ষেত্রে বাদীপক্ষ মামলা পরিচালনায় অনীহা দেখায় বা গোপনে আপস করে ফেলে। তখন বাদীপক্ষ সাক্ষ্য দেয় না বা দিলেও যথাযথভাবে সাক্ষ্য না দেয়ায় আসামি খালাস পেয়ে যায়। আবার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর অনুপস্থিতির কারণেও মামলা প্রমাণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রসিকিউশনের দুর্বলতার কারণেও আসামি খালাস পায়। তাছাড়া হয়রানির জন্য ঘটনা যা, তার চেয়ে বাড়িয়ে লিখে অনেক ক্ষেত্রে মামলা হয় কিন্তু তা সাক্ষ্যে প্রমাণিত হয় না। আর অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় না। তাছাড়া সাক্ষ্যপ্রমাণে সন্দেহ তৈরি হলে সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী আসামি বেনিফিট অব ডাউটের কারণেও সুবিধা পায়। তারপর সামগ্রিক দিক বিবেচনায় অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ারও সুযোগ রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, ইদানিং রাজনৈতিক যে মামলাগুলো হয়েছিল, সেগুলোয় আসামিরা সাক্ষীর অভাবে খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। যে কারণে খালাসের হার বাড়তে পারে। তাছাড়া, বিশেষ করে নারী ও শিশু আইনের অধিকাংশ মামলায় আপস-মীমাংসা হয়ে যায়। মাদকের মামলায় অনেক সময় সাক্ষী পাওয়া যায় না। অধিকাংশ মামলায়ই ভ্রাম্যমাণ সাক্ষী থাকে, যার ফলে পরবর্তী সময়ে সাক্ষীদের পাওয়া যায় না। এজন্য এসব মামলায় স্থানীয় লোকজনের সাক্ষ্য নেয়া উচিত।
এদিকে এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, পুলিশ চেষ্টা করে যাতে অপরাধীর সাজা হয়। সেজন্য পুলিশের তরফ থেকে করণীয়গুলো সুচারুভাবে পালন করা হয়। সুষ্ঠু তদন্তের পর চার্জশিট দাখিল হয়। তদন্তের বিভিন্ন ধাপে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সঠিক অপরাধীকেই চার্জশিটভুক্ত করা হয়। তারপরও নানা কারণে অনেক সময় সাজার হার কমে যায়। যেমন সাক্ষী আসে না, মামলা কমেপ্রামাইজ হয়ে যাওয়া।
অন্যদিকে এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ প্রসিকিউটোরিয়াল উপদেষ্টা ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী জানান, প্রথমত কোনো ফৌজদারি মামলায় আসামি খালাস পাওয়ার ক্ষেত্রে কতগুলো কারণ থাকে। এক নম্বর কারণ হলো মামলার অভিযোগকারী পক্ষ অ্যাভিডেন্সের মাধ্যমে পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ না দেয়ায় আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। দ্বিতীয়ত হলো, অনেক সময় মামলায় সাক্ষীরা আসেন না। এ কারণে অনেক সময় খালাস করে দেন। আবার অনেক সময় আপস-মীমাংসার ভিত্তিতেও আসামিদের খালাস করে দেয়া হয়। এই ৮৮ শতাংশ যারা খালাস হয়েছেন, যদি সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে খালাস পেয়ে থাকেন, আর প্রসিকিউশন যদি মনে করে এ খালাস অন্যায় হয়েছে, তখন উচ্চ আদালতে অর্থাৎ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এ খালাসের বিরুদ্ধে আবেদন করতে পারে। যেসব মামলায় খালাস দেওয়া হচ্ছে, তার কপি জেলা বা মহানগর জজ ও পাবলিক প্রসিকিউটরকে দেয়া উচিত। তখন তারা বিবেচনা করে দেখবেন এই মামলা রাষ্ট্রের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। যদি দেখে এই আদেশ ন্যায়বিচারের পরিপন্থি হয়েছে, সেক্ষেত্রে পাবলিক প্রসিকিউটর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত নিয়ে উচ্চতর আদালতে একটা রিভিশন দায়ের করতে পারেন।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

ঢাকায় নিম্ন আদালত থেকে খালাস পাচ্ছে আসামিরা
- আপলোড সময় : ২০-০৭-২০২৫ ০৭:০৭:৫৭ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ২০-০৭-২০২৫ ০৭:০৭:৫৭ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ